কুইন্স_প্যালেস_(অভিশপ্ত রাজবাড়ি) -১ম_পর্ব

কাল রাত থেকেই নিঁখোজ রায়পুরের ডিসি সাহেবের মেয়ে। সন্ধ্যাবেলায় কোচিং এ যাওয়ার জন্য বের হওয়ার পর আর বাসায় ফিরেনি তার মেয়ে।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এলাকাবাসীদের কথা। কেউ বলছে, "আহারে, মেহেরূপা ডিসি সাহেবের মেয়েকেও ছাড়েনি।"
আবার কেউ বলছে, "এতরাতে ঐ ভয়ানক জায়গা দিয়ে আসার দরকার কি ছিলো? পেয়েছে আরকি মেহেরূপার আত্মা!"
এ ঘটনার পর পুরো এলাকা জুড়ে এই ধরণের কানাফোশা শুরু হয়ে যায়।
..
পুলিশ ইতমধ্যে তাদের ইনভেস্টিগেশন চালু করে দিয়েছে। এলাকাবাসীরা যে ভয়ানক জায়গার কথা বলছে সেই জায়গাটি হলো "কুইন'স প্যালেস"। এটি একটি পরিত্যক্ত প্যালেস। প্রায় অনেক বছর ধরে বন্ধ। আর নানান প্যারানরমাল কর্মকান্ডের জন্য এই প্যালেসটি খোলার সাহস আজ পর্যন্ত কেউ করেনি।
.
পুলিশ অফিসার সাধণ জিজ্ঞেস করলেন,
-- এই প্যালেস পরিত্যক্ত হওয়ার কারন কি?
.
~ স্যার, অনেক বছর আগে এই প্যালেসটায় এক জমিদার থাকতো। জমিদারের একমাত্র মেয়ে ছিলো মেহেরূপা। মেহেরূপার জন্যই বানানো হয় প্যালেসটা। কিন্তু কয়েকবছর পরই হঠাৎ বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার কারনে মেহেরূপাসহ তার মা-বাবার মৃত্যু হয়। তখন থেকেই মেহেরূপার আত্মা এই প্যালেসটায় ঘুরছে। আর কিছুদিন পর পর তার সমবয়সী মেয়েদের সে গায়েব করে ফেলে। এর আগেও মেহেরূপা কয়েকজন মেয়েকে গায়েব করেছে কিন্তু কোনোদিন পুলিশ কোনো মেয়েকে পায়নি।
.
ইন্সপেক্টর সাধণ মাথায় হাত দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে বললেন, 'এই প্যারানরমাল ক্যাস সলভ করা পসিবল না, ভুতকে জেলে দিবো নাকি?'
..
এদিকে পুরো পুলিশ হেডকোয়ার্টার মাথায় তুলে নিয়েছেন ডিসি সাহেব। সকল পুলিশ ও ডিবি অফিসারদের নিয়ে জরুরি মিটিং ডাকা হলো।
.
ডিসি সাহেব বললেন,
-- আই ওয়ান্ট দ্যা স্ট্রংগেস্ট টিম ফর দিস কেস।
.
হেডকোয়ার্টারের সিনিয়র কর্মকর্তারা মিলে ৭ জনের একটা টিম করে দিলেন। সবচেয়ে বিচক্ষণ অফিসার সাহিব খানকে ইনচার্জ করলেন এই কেস এর।
কিন্তু টিম নিয়ে এখনো সন্তুষ্ট নন ডিসি সাহেব। অফিসার সাহিব খান বললেন,
-- স্যার আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার মেয়েকে আমরা কিছু হতে দিবোনা।
.
মিনিস্টার সাহেব ডিসি মুসলিম খানকে বললেন,
~ মুসলিম, কি হলো? তোমার জন্য আমরা আমাদের সেরা টিমটি দিয়েছি।
.
ডিসি সাহেব বললেন,
-- আমি কেইসে গার্সিয়া'কে চাই। একমাত্র স্টিফেন গার্সিয়া'ই পারবে আমার মেয়েকে ফেরাতে।
.
সাহিব খান একটু রেগে মিনিস্টারকে বললেন,
~ স্যার, এখানে তো আমার অপমান করা হচ্ছে। এইমাত্র আমাকে ইনচার্জ করলেন, এখন আবার উনি স্টিফেন গার্সিয়াকে চাইছেন। হোয়াট ইস দিস? আমিও স্টিফেনের চেয়ে কম কিছু না।
.
মিনিস্টার সাহেব বললেন,
-- তুমি আর স্টিফেন দুজনই এই কেইসে লিড দিবা।
মিনিস্টার সাহেব স্টিফেনকে ফোন করলেন। স্টিফেন ফোন রিসিভ করলে তাকে সব খুলে বলা হয়।
.
স্টিফেন বললো,
-- হাহা স্যার। ঐ প্যালেসের সামনে নাকি আরো কয়েকজন মেয়ে গায়েব হয়েছে, তখন তো সামান্য পুলিশ দিয়ে কেস দু একদিনের মধ্যে কোনোমতে চাপা দিয়েছেন। আজ ডিসি সাহেবের মেয়ে গায়েব হয়ে হয়েছে বলে ডিরেক্ট আমাকে ডাকছেন? আমাদের দেশ কখনো চেঞ্জ হবেনা। এনিওয়ে, আ'ম রেডি ফর ইট। আধঘন্টার মধ্যে হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করছি স্যার।
.
~ ওকে।
..
স্টিফেনের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ডিসি সাহেব, কারন এই মানুষটাই পারবে তার মেয়েকে বাঁচাতে।
এদিকে অফিসার সাহিব খানকে এখনো কেসের ইনচার্জ রাখা হলেও স্টিফেনের অন্তভূক্তিতে তিনি কিছুটা নারাজ।
..
বরাবর ৩০ মিনিট পর স্টিফেন হেডকোয়ার্টারে আসলেন। পরিচিত হলেন টিম মেম্বারদের সাথে। সাহিব খানকে দেখে স্টিফেন বুঝেই গিয়েছে যে তার উপস্থিতিতে এই মানুষটা খুশি না।
যাই হোক, দেরী না করে স্টিফেন সেই জায়গার আগের কেস এর ফাইলগুলো পড়া শুরু করলেন। সব কেসই অর্ধেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
.
ঠিক সেই মূহুর্তে সাহিব খান এসে স্টিফেনকে বললো,
~ মহাশয়, শুধু বসে বসে ফাইল ই পড়বেন? নাকি রায়পুর গ্রামে গিয়ে ইনভেস্টিগেশন চালু করবেন?
.
স্টিফেন তার কথার কোনো জবাব দিলো না।
.
~ এই যে আপনাকে বলছি!
.
-- তুমি যাও আমি আসছি।
..
সাহিব খান তার টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে চলে গেলো। পরে স্টিফেন একাই গেলো রায়পুরে।
..
স্টিফেন রায়পুর গিয়ে আগে দাঁড়ালো 'কুইন্স প্যালেস' এর সামনে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রায় কয়েকবছর ধরেই পরিত্যক্ত এই প্যালেসটি। প্যালেসের চারপাশে উঁচু উঁচু দেয়াল। মেইন গেটটি আচ্ছাদিত লতাপাতা আর ধুলাবালিতে।
বাহির থেকে দেখেই ভয় গা শিউরে উঠার মতো একটা প্যালেস। স্টিফেন মেইন গেইটের ছোট্ট দরজাটি খুললো ভিতরে ঢোকার জন্য। গেইট দিয়ে ঢুকেই মাটিতে পা ফেলার সাথে সাথে মড়মড় করে উঠলো শুকনো পাতা আর খড়কুটোর শব্দে। মেইন গেইটের পরই উঠান। পুরো উঠান জুড়েই শুকনো পাতা।
স্টিফেন প্যালেসের বাহিরের চারপাশ ঘুরেঘুরে দেখতে লাগলো। প্যালেসের ডান পাশে আঁকাবাঁকা ছোট্ট ছোট্ট পাথর একটা শুকনো নালা। হয়তো আগে প্যালেসে যখন মানুষ থাকতো তখন এই নালা দিয়ে পানি বেরিয়ে মেইন ড্রেইনে মিশে যেতো। প্যালেসের পিছনেই রয়েছে পুরোনো পরিত্যক্ত বাগান। বাগানের মাঝ বরাবর স্টিলের একটা দোলনা। মরিচা ধরেছে পুরো দোলনায়। প্যালেসের চারপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ মাগরিবের আজান শুনতে পায় স্টিফেন। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। পকেট থেকে টর্চটা বের করে স্টিফেন ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে জায়গাটা। প্যালেসের একদম পিছনে মেজর জিয়াউর রহমানের ইউনিফর্ম গায়ে এবং বন্দুক হাতে একটা ছবি।
স্টিফেন মুচকি হেসে ভাবলো, প্যালেসের মালিক হয়তো বিএনপি ছিলেন।
বাগানের ভিতর খুবই পুরাতন কিছু নীল ড্রাম আর বোতল। এসবের ভিতর শুকনো মরা মাটি। হয়তো এক সময় এই মাটি জীবিত ছিলো পানির ছোঁয়ায়, আর এসব মাটির উপর ছিলো নানান ধরণের ফুলের চারা।
অন্ধকার হয়ে এসেছে। চারপাশটাও বেশ ভালোভাবে দেখা হয়ে গিয়েছে স্টিফেনের। স্টিফেন এবার প্যালেসের ভিতরে ঢুকার জন্য প্যালেসের সামনের দিকে গেলো।
প্যালেসের দরজার সামনে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। অদ্ভুদ এক ভাবের রেখা তার কপালে। হয়তো ভাবছে, এই সময়টায় কি একা এই প্যালেসে ঢোকা ঠিক হবে?
পরক্ষণেই সে ভাবলো, আমি এসব কি ভাবছি?
.
প্যালেসের দরজা খোলার জন্য হাত বাড়াতেই তার ফোনে কল আসলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সাহিব খানের কল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভারী স্বরে সাহিব খান বলে উঠলেন,
~ আপনার ফাইল পড়া শেষ? আসবেন রায়পুরে?
.
-- আমি রায়পুরেই আছি। তোমরা কোথায়?
.
~ আমরা গ্রামের কাউন্সিলর সাহেবের অফিসের বাহিরে।
.
-- ওকে আসছি আমি।
..
একটু পরই স্টিফেন কাউন্সিলর সাহেবের অফিসের সামনে গেলো। সাহিব খান আর তার টিম বাহিরে গ্রামবাসীর সাথে কথা বলছে। স্টিফেন গাড়ি থেকে নামতেই সাহিব খান রাগান্বিত চোখে তার দিকে তাকালো।
সাহিব খান জিজ্ঞেস করলো,
~ কই ছিলা এতক্ষণ?
.
স্টিফেন এবার বলে উঠলো,
-- শাট আপ! মিস্টার সাহিব খান, আমি কোথায় যাবো, কি করবো, এসব তোমার শিখাতে হবেনা আমাকে। অয়েল ইউর অউন মেশিন। লেট মি ডু মাই জব।
.
স্টিফেন কাউন্সিলর সাহেবের সাথে দেখা করতে কাউন্সিলর অফিসের ভিতরে ঢুকলেন। স্টিফেনকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন কাউন্সিলর, আর বললেন,
~ আসেন স্যার। ডিসি সাহেব আমাকে বলেছেন আপনার কথা। অনেক শুনেছি আপনার ব্যাপারে।
.
স্টিফেন চেয়ারে বসে কাউন্সিলর সাহেবকে বললেন,
-- আপনার গ্রামে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে কোনো কিছুর খবর রেখেছেন কি?
.
~ না স্যার। আসলে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি আগের কেসগুলোতেও, পুলিশের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো রহস্যই আমরা সমাধান করতে পারিনি। আসলে স্যার, অন্যভাবে নিবেন না। আমিও খুব প্রেক্টিক্যাল মানুষ, কিন্তু এসব পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এখানে নিশ্চয় প্যারানরমাল কিছুর স্পর্শ আছে। আর ঐ প্যালেসটি জমিদার সাহেবের পরিবারের মৃত্যুর পর খোলার সাহস কেউ করেনি। আর একটা প্যালেস এতবছর ধরে পরিত্যক্ত হলে সেখানে জ্বিন-ভুতের আস্তানা তো হবেই। তাই বলছি এটা নরমাল কোনো কেস না, তা না হলে এতো চেষ্টার পরও কোনো সমাধান হয়নি কেনো আগে কেস গুলোতে?
.
-- কারন আগের কেসগুলোতে স্টিফেন গার্সিয়া ছিলোনা!
এই বলে স্টিফেন বেরিয়ে গেলো কাউন্সিলরের অফিস হতে।
..
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কাউন্সিলর অফিসের সামনে। গ্রামের প্রতিটা মানুষের হাঁটাচলা, কাজকারবার সবকিছু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো সে।
একটু পর ডিসি সাহেবের কল আসলো। রিসিভ করতেই ডিসি সাহেব খুবই অসহায় গলায় বললেন,
~ স্টিফেন, কিছু জানতে পেরেছো? ২৪ ঘন্টা হয়ে গেলো আমার মেয়েটা ঘরে আসেনি।
এই বলে কেঁদে দিলেন ডিসি সাহেব। এপাশ থেকে নিশ্চুপ স্টিফেন। ডিসি সাহেবকে শান্তনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই নেই স্টিফেনের কাছে।
.
হঠাৎ স্টিফেন ডিসি সাহেবকে প্রশ্ন করলো,
-- স্যার, আপনার মেয়ে এই গ্রামে কোন কাজে এসেছিলো?
.
~ আসলে আমার এক ফ্রেন্ড আছে ঐ গ্রামে, ডাঃ আহসান হাবীব। তার মেয়ে আমার মেয়ের বান্ধবী। তারা দুজন একসাথে প্রাইভেট পড়ে। হয়তো তাকে পিক করতে গিয়েছিলো বা আসার সময় ড্রপ করতে গিয়েছিলো।
.
-- আচ্ছা আপনি টেনশন করবেন না। আই প্রমিস, আমি আপনার মেয়েকে আপনার কাছে ঠিকমতো এনে দিবো।
..
কেসটা খুবই কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে স্টিফেনের জন্য। গ্রামবাসীর কথা ধরলে সবকিছুই মেহেরূপার আত্মা করছে। কিন্তু স্টিফেন কোনোভাবেই এটা মানতে রাজি না।
এদিকে আবার ডিসি সাহেবের সব আশা ভরসা স্টিফেনের উপর। চাপ দুদিক থেকেই বেড়ে গিয়েছে স্টিফেনের উপর।
..
স্টিফেনের হঠাৎ চোখ গেলো অল্প দূরত্বে অবস্থিত এক চায়ের দোকানের দিকে। ছোট্ট একটা স্টল, আর বাহিরে দুটো বেঞ্চ। স্টিফেন বেঞ্চে বসে এক কাপ চা অর্ডার করলেন। রাত প্রায় নয়টা বেজেছে। গ্রামে বসে এই সময়ে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা স্টিফেনের প্রথম।
চায়ে চুমুক দিতেই স্টিফেনের চেহারা অনেকটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। কয়েক ঢোক চা খেয়েই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। হঠাৎ স্টিফেন দেখতে পেলো তার সামনের বেঞ্চে এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে। সুট পরা এক ওল্ড জেন্টেলম্যান। হাতে একটা ইংরেজি পত্রিকা। চা খেয়ে খেয়ে কি যেনো পড়ছিলেন পত্রিকায়। স্টিফেন একটু অবাক হলো যে, এই গ্রামে এতো জেন্টেলম্যান একজন লোক তাও ইংরেজি পত্রিকা পড়ছেন। উনি আবার কে?
স্টিফেন তাকিয়েই আছে সেই বৃদ্ধ লোকটির দিকে। হঠাৎ বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠলেন,
~ হেই ইয়াং ম্যান। হোয়াই আর ইউ কন্টিনিউসলি লুকিং এট মি?
.
স্টিফেন একটু চমকে উঠলো। আর বললো,
-- নাথিং।
.
~ এনি প্রব্লেম?
.
-- নো, নাথিং সিরিয়াস।
.
~ আই ক্যান ক্লিয়ারলি এ বিগ প্রব্লেম ইন ইউর হেড। ডোন্ট ওয়ারি। জাস্ট লিসেন টু ইউর হার্ট। ইউ উইল রিচ ইউর ডেস্টিনেশন।
.
স্টিফেন বলে উঠলেন,
-- বাট, হু আর ইউ?
.
~ আই এম সামওয়ান দেট ইউ কান'ট ইভেন ইমেজিন!
..
এই বলে বৃদ্ধ লোকটি উঠে চলে গেলেন। সাথে চায়ের কাপটিও হাতে করে নিয়ে গেলেন। আর সবচেয়ে অবাক জিনিস হলো চায়ের কাপ এই লোকটি নিয়ে চলে গেলেন কিন্তু দোকানদার কিছুই বললো না। স্ট্রেইঞ্জ!
..
যাই হোক, রাত বেশি হয়ে যাওয়ার কারনে দোকানদারকে টাকা দিয়ে চলে আসলাম রায়পুর হতে।
..
সারারাত অফিসেই বসেছিলো স্টিফেন। কোনো কেস আসলে তা সল্ভ করার আগে বাসায় না যাওয়াটা তার পুরোনো স্বভাব।
প্রায় মধ্যরাত হয়ে গেলো। তর্জনী ও মধ্যমা'র মাঝে কলম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেনো ভাবছিলো।
.
আজ গ্রামে গিয়ে অনেক কিছুতেই খটকা লাগলো তার মনে। প্রথমে তো সেই 'কুইন্স প্যালেস', দেখতে খুব হরর টাইপের প্যালেস কিন্তু সত্যিই কি এখানে আত্মা আছে?
তার উপর আবার কাউন্সিলর সাহেবের এতো দায়িত্বহীন চিন্তাভাবনা। সোজাসুজিই বলে দিলেন যে, এখানে আত্মা আছে।
কন্সটেবল জামিল স্টিফেনের কেভিনের বাহিরে বসে আছে। জামিলকে ডেকে স্টিফেন বললো,
-- জামিল, কি মনে হয়, এসবের পিছনে কি কাউন্সিলর সাহেবের হাত আছে?
.
~ আমার মনে হয়না স্যার। দেখে তো ভালোই মনে হলো।
.
-- চোরের মাথায় কি লেখা থাকে "আমি চোর"?
.
~ তা না, কিন্তু উনাকে একটু তারাতাড়িই সন্দেহ করছেন না স্যার?
.
-- হা হা, সন্দেহ করাটা আমাদের কাজ। আচ্ছা যাও তুমি।
...
পরদিন সকালে আবারো রায়পুর গেলো স্টিফেন। সব ধরণের মানুষের কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলো। বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে কথা বললেও সবার মুখে একই কথা, আর তা হলো "কুইন্স প্যালেসে আত্মা থাকে স্যার। এসব মেহেরূপা'র আত্মার কাজ।"
সবার সাথে কথা বলার সময় স্টিফেনের চোখ গেলো দূরে একটা লোকের দিকে। হাফ শার্ট আর লুঙ্গি পরা। দূর থেকে সে কি যেনো ইশারা করছিলো স্টিফেনকে। হয়তো সে স্টিফেনের সাথে একা কথা বলতে চায়। ছেলেটা যে দূর থেকে স্টিফেনকে ডাকছিলো, তা অফিসার সাহিব খানও দেখতে পেলেন। তিনিও গেলেন স্টিফেনের সাথে।
.
স্টিফেন আর সাহিব খান যাও মাত্রই সে তাদেরকে চুপিসারে বললো,
~ স্যার, একহান কথা ছিলো, এহানে একটা কথা ছিলো যা কাউন্সিলর সাহেবের ডরে আপনাগোরে কেউ বইলবেনা। আর তা হইলো যে স্যার, কাউন্সিলর সাহেবের ইস্তিরি মাভিয়া খাতুন কালা যাদু করে। বেলেক ম্যাজিক স্যার, বেলেক ম্যাজিক!
.
এই বলে লোকটি দৌঁড়ে চলে গেলো। স্টিফেন আর সাহিব খান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সাহিব খান বলে উঠলেন,
~ এইবার বুঝলাম কাউন্সিলর সাহেব কেনো বারবার আত্মার কথা বলছিলেন। কারন আসল কালপ্রিট তো তার ওয়াইফ। কাউন্সিলর সাহেবের স্ত্রীই ব্ল্যাক ম্যাজিক দিয়ে এসব করছে।
.
-- সরাসরি কিছু বলা যাবেনা। আগে কাউন্সিলর সাহেবের বাসায় গিয়ে একবার ঘুরে আসতে হবে।
..
দাঁড়িয়ে সাহিব খানের সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ মনের ভুলে পাশের দেয়ালের কাঁচ ভাঙার উপর হাত রাখতেই হাত কেটে গেলো স্টিফেনের। সাথে সাথেই ব্লিডিং হওয়া শুরু হলো।
একজন লোক বললেন, স্যার আপনি আমার সাথে চলুন, আমাদের গ্রামে এক অভিজ্ঞ ডাক্তার আছেন।
..
স্টিফেন লোকটির সাথে সেই ডাক্তারের বাসায় গেলো। ঘরের বাহিরে লিখা ছিলো, "ডাঃ আহসান হাবীব"। স্টিফেনের বুঝতে দেরী হলোনা যে এটাই ডিসি সাহেবের বন্ধু।
ডাক্তার স্টিফেনের হাত ব্যান্ডেজ করে দিলেন। স্টিফেন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন,
-- আপনি ডিসি সাহেবের বন্ধু না?
.
~ আরে আপনি কেমনে জানেন?
.
-- ডিসি সাহেব বলেছেন আপনার কথা।
.
-- ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনিই তার মেয়ের কেস হ্যান্ডেল করছেন?
.
~ জ্বী। ডাক্তার সাহেব, আপনার বাহিরে কোনো চেম্বার নেই?
.
-- জ্বী না। আসলে একটু দূরেই গেলে একটা বন্ধ হসপিটাল দেখবেন। নাম "আইভাম হসপিটাল"। এটা আমার হসপিটাল, গ্রামের মানুষের জন্য খুলেছিলাম।
.
~ তাহলে টা বন্ধ কেনো?
.
-- আমার হসপিটালের এক ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার কারনে এক রোগীর প্রাণ গিয়েছিলো। আর তারপর থেকে হসপিটাল তো বন্ধ হলো, সাথে আমার লাইসেন্সও গেলো। এরপর থেকে গ্রামের ভিতরই টুকটাক রোগী দেখি।
.
~ ওহ। তাহলে ডাঃ সাহেব চলি আমি। আজ রাতে 'কুইন্স প্যালেসের' ভুত গুলার সাক্ষাৎকার নিতে হবে।
.
-- হা হা হা।
..
বাম হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে স্টিফেন চলে আসলো ডাক্তারের বাসা হতে।
..
স্টিফেন আসার পর সাহিব খান বললেন,
~ হাত ঠিকাছে?
.
-- হুম। মানুষের কাছ থেকে শুনছি কুইন্স প্যালেসে নাকি রাতে আত্না নামে। আজ রাতে গিয়ে দেখতে হবে কি আছে কুইন্স প্যালেসের ভিতর।
.
~ ওকে।
...
রাতের দিকে স্টিফেন, সাহিব খান আর দুইজন কন্সটেবল পাঁয়ে হেঁটে রওনা দিলেন কুইন্স প্যালেসের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে তারা হঠাৎ কমিশনার সাহেবের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অদ্ভুদ কিছু শব্দ শুনতে পেলেন। মন্ত্র জাতীয় শব্দ। কে যেনো বসে বসে ফিস করে মন্ত্র পড়ছে।
তারা একটা জানালা খোলা দেখলো। জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই তারা দেখলেন একজন মহিলা মন্ত্র পড়ে পড়ে ক্রমাগত একটা ধারালো ছুরি দিয়ে লেবুর মধ্যে আঘাত করছিলেন। আর সবচেয়ে গা শিউরে উঠার বিষয় হলো লেবুটির গায়ে যতবার ছুরিকাঘাত করা হচ্ছিলো ততবার লেবুটির গা বেয়ে তাজা রক্ত ঝরছিলো।
জামিল বলে উঠলো, স্যার এটাই কমিশনার সাহেবের স্ত্রী, মাভিয়া খাতুন।
.
সাহিব খান বললেন, তার মানে ঐ লোকটির কথা ঠিক। এই মহিলা ব্ল্যাক ম্যাজিক করে। এক্ষুনি গিয়ে ধরি।
.
স্টিফেন সাহিব খানকে বাধা দিয়ে বললো, না এখন কিছু করা ঠিক হবেনা। আমরা যে কাজে যাচ্ছি সেই কাজেই যায়। পরে দেখবো এসব।
এই বলে তারা প্রস্থান করলেন সেখান থেকে।
..
রাত প্রায় দশটা বাজলো। স্টিফেন, সাহিব খান আর দুইজন কন্সটেবল দাঁড়িয়ে আছেন 'কুইন্স প্যালেসের' সামনে।
গ্রামে রাত দশটা মানে অনেক গভীর রাত। চারদিকে আঁধার। প্যালেসের সামনের রাস্তায় থাকা ভাঙা ল্যাম্পপোস্টটির কিঞ্চিত আলোতে দেখা যাচ্ছিলো 'কুইন্স প্যালেস'।
কন্সটেবল জামিল প্যালেসের মেইন গেটটি খুললো, খোলার সাথে সাথেই শব্দ হলো মরিচাধরা রডের সেই গেইটে।
ভিতরে ঢুকে তারা আস্তে আস্তে প্যালেসের দরজার দিকে এগোতে লাগলো। রাতের বেলায় পাতার মড়মড় শব্দগুলো বেশ ভয়ানক লাগছিলো। দরজার আগে ছোট তিন-চারটে সিঁড়ি। তারা উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
দরজা দুটি বেশ বড়সড়। পুরো দরজা জুড়ে ধুলোময়লা আর মাকড়সার জাল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বহুবছর ধরেই খোলা হয়নি এই দরজা। বাহিরের তালাটি ভাঙলো জামিল। ধাক্কা দিতেই ক্যাড়ক্যাড় কাঠের শব্দে খুপে গেলো দরজাটি।
.
বাহিরে যে পরিমান ধুলাবালি, ভিতরে তার চেয়েও বেশি। সাহিব খান কাঁশি দিতে দিতে বললেন,
~ এখানে ভুত থাকলে সেও মরে যাবে!
.
খুবই বড় এবং রাজকীয় প্যালেসের ভিতরটা। সব ধরণের জিনিসপত্র কাপড় দিয়ে ঢাকা। প্যালেসের ভিতরে সর্বডানে একটা চওড়া সিঁড়ি যা দিয়ে দোতলায় উঠা যাবে। তারা চারজন একটা করে টর্চ নিয়ে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।
.
স্টিফেন হঠাৎ ডান পাশের দেয়ালে টর্চ মেরে দেখলো একটা ফটো ফ্রেম। কিন্তু ধুলোর জন্য ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিলো না।
স্টিফেন পকেট থেকে রুমাল বের করতেই সাহিব খান তার পিছনে এসে দাঁড়ালেন, আর বললেন,
~ আমাকে দাও, আমি মুছি। তোমার হাতে ব্যান্ডেজ।
..
সাহিব খান ফ্রেমের গ্লাসটি মুছার পর তারা দুজন দেখতে পেলেন একটি ফ্যামিলি ফটো। একজন পুরুষ, একজন মহিলা আর একটা তরুণী। বুঝার বাকি রইলোনা এটাই মেহেরূপা আর তার মা-বাবা।
তারা ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ জামিলের চিৎকার শুনতে পেলো। যেনো ভয়ানক কিছু দেখেছে সে।
স্টিফেন আর সাহিব খান ছুটে গেলেন জামিলের দিকে আর জিজ্ঞেস করলেন, কি হলো তার। এভাবে চিৎকার করছে কেনো সে।
জামিল কিছুই বললোনা। শুধু তার ডান হাতটি উঁচিয়ে স্টিফেন আর সাহিব খানকে কি যেনো দেখতে বলছিলো সে।
স্টিফেন আর সাহিব খান উপরের দিকে তাকাতেই তাদের পাঁয়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে গেলো। তারা দেখতে পেলেন তিনটি মানুষ আকৃতির কিছু শূন্যে ভাসছে।
তারা চারজন একসাথে টর্চ মারতেই দেখতে পেলো, তিনটা লাশ শূন্যে ভাসছে। আর এই তিনজনের চেহারার এক পাশ ঝলসে গিয়েছে। খুবই ভয়ানক দেখতে। কিন্তু এর ভিতরও তাদের চিনতে দেরী হলোনা যে এরা তারাই যাদের একটু আগে ফটো ফ্রেমে দেখেছে। অর্থাৎ মেহেরূপা ও তার মা-বাবার লাশ। তিনটি লাশই ভাসছিলো শূন্যে। এই ভয়ানক দৃশ্য স্টিফেনের সব হিসাবনিকাশ আর চিন্তাভাবনা উলটপালট করে দিলো। সে বিশ্বাসই করতে পারছিলোনা নিজের চোখকে।

চলবে…...
কুইন্স_প্যালেস_(অভিশপ্ত রাজবাড়ি) -১ম_পর্ব কুইন্স_প্যালেস_(অভিশপ্ত রাজবাড়ি) -১ম_পর্ব Reviewed by NINDOOK LIFE on January 28, 2020 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.