একজন ডাক্তার কেন কাঁদে না?
মেডিকেলে এসে প্রথম দিনেই সে বড়সড় ধাক্কা খায়। এনাটমী ডিপার্টমেন্টে একটা ঘুমন্ত লাশ দেখে। দশ বা বিশ বা তারো অনেক বছরের পুরোনো লাশ। ঘুমন্ত লাশের গায়ে কাপড় নেই। লজ্জাস্থান ঢাকা নেই। বুকের উপর কাপড় নেই। বুকের চামড়া মাঝ বরাবর কেটে ফেলা। গাছের বাকলের মতো করে চামড়া কেটে পেশী, রক্তনালী এবং নার্ভগুলো বের করা থাকে। প্রথমদিন থেকেই তাকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেই কাটাকুটো অংশগুলো টানাটানি করে পড়তে হয়। ফরমালিনের ঝাঁঝে চোখের সব পানি ঝরে যায়।
দ্বিতীয় ধাক্কাটা খায় ফরেনসিকে। মর্গে গলায় রশি দিয়ে মরা, গলা কেটে মারা, চুবিয়ে মারা, আট টুকরো লাশের জমাটবাধা রক্তপিণ্ড দেখে সে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কান্নার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলে। কান্না একদিন এসেছিল। মৃত গলিত মায়ের জরায়ু কেটে যখন মৃত মায়ামাখা সুন্দর একটা শিশুকে বের করে এনেছিল স্যার। কান্না থেমে গিয়েছিল, যখন স্যার গমগম গলায় বললেন-------যে লোকটা এই মেয়েটার পরিণতির জন্য দায়ী তাকে গলাকেটে হত্যা করা খুব পাপের কাজ হবে? আমরা মুষ্ঠিবদ্ধ করে বলেছিলাম, তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারলেও পাপ হবেনা।
তৃতীয় ধাক্কাটা খায় ইমার্জেন্সিতে রোগী দেখে। হাত পা পুড়ে ঝলসে গেছে কিন্তু তখনো হৃদপিন্ডটা ধকধক করে কাঁপছে। বুকের পাজর ফেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কিন্তু রোগী কষ্ট করে কোনমতে হৃদপিন্ডটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যেদিন আমার কোন সমস্যা নেই বাবা, শুধু বুকটা ভারী লাগছে বলার পর ইসিজি করতে করতেই লোকটা চোখ বন্ধ করে, ইসিজির গ্রাফ ফ্লাট হয়ে থাকে, সেদিন থেকে সব কান্না হারিয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখের কান্না দূর করতে কাউকে না কাউকে তো নিজের কান্না গোপন রাখতেই হবে।
- ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
No comments: