প্রত্যাখ্যান- Part_10

প্রত্যাখ্যান 💔

Israt Jahan Tanni
Part_10
..
নুপুরের মা বাবার কাছে সবটা খোলে বললো রাজ। নুপুরের উপর কি কি অত্যাচার করেছে, কেন করেছে .. সবটাই বলেছে রাজ। নুপুরের মা রাজের কথা শুনে কান্না করতে লাগলো। নুপুরের বাবার চোখেও দুফোটা পানি এসে গেলো। আজ নিজেকে খুব দোষী ভাবছেন তিনি। উনি যদি সেদিন সবটা মেয়েকে খোলে বলতেন তাহলে হয়তো আজ এই দিন দেখতে হতো না। নুপুরকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা আর প্রেগ্নিন্যান্সির কথাটাও বললো নুপুরের মা বাবাকে। নুপুরের বাবা তো রেগে আগুন। রাজকে তিনি যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছেন। রাজ কোনো প্রতিবাদ করছে না। নুপুরের বাবা বলতে লাগলো..
- তোর এতো বড় সাহস? আমার মেয়েটাকে ছলনা করে বিয়ে আমাদের থেকে পর করে দিলি। আরে .. একটা বনের পশুও যদি অনেকদিন কারো কাছে থাকে তাহলে তার জন্যও তো মানুষের একটা মায়া হয়। আর আমার মেয়েটা তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ ছিলো। আমার মেয়েটার জন্য কি একটু দয়া হলো না তোর? দয়া যদি নাই হয়ে থাকে, আমিযে তোকে এতোগুলো টাকা দিলাম সেগুলোর জন্য হলেও আমার মেয়েটাকে একটু সুখ দিতি। তুই কি মানুষ? কথাগুলো বলছে আর কাঁদছে নুপুরের বাবা।
রাজ আসামির মতো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। কিছুই বলছে না। নুপুরের মা বললো..
- এখন ছেলেটার সাথে রাগারাগি করলে কি কিছু হবে? ভুল নাহয় করেই ফেলেছে। এখন ওইসব চিন্তা বাদ দিয়ে মেয়েটাকে তো খোজতে হবে নাকি? না জানি আমার মেয়েটা কোথায় আছে। কতোই কষ্টই না জানি করছে পেটের বাচ্চাটাকে নিয়ে।
নুপুরের মা ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
নুপুরের বাবা রাজকে উদ্দেশ্য করে বললো..
- আগে আমার মেয়েটাকে পাই, তোকে পরে দেখবো।
বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নুপুরের বাবা। রাজ ও কিছুক্ষন সেখানে থেকে বেরিয়ে এলো।
..
এরপর থেকে শুরু হলো নুপুরকে খোজা। এদিকে রাজ খোজছে তো ঐদিকে নুপুরের বাবা খোজছে। আর নুপুরের মা ঘরে বসে শুধু কাদে।
একদিন নুপুরের মা বসে কাদছিলো। তখন নুপুরের ছোট বোন নীরা এসে মায়ের পাশে বসে।
- জানো মা, একদিন আপু আমার সাথে আমার স্কুলে দেখা করতে এসেছিলো।
নুপুরের মা চমকে নীরার দিকে তাকায়।
- কবে এসেছিলো আমার নুপুর?
- কয়েক মাস আগে এসেছিলো। তোমাদের খবর নিতে।
- কিছু বলেনি ?
- হ্যাঁ জিজ্ঞাসা করেছিলো তোমরা কেমন আছো। আমি বলেছিলাম ভালোই আছো।
- আর কিছু বলেনি রে মা? খুবই উতকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো নুপুরের মা।
- জিজ্ঞেসে করেছিলো মা। তোমরা ওর কথা কিছু বলো কিনা, আপুকে মনে করো কিনা সেসব জিজ্ঞাসা করেছিলো।
মাথা নিচু করে বললো নীরা।
নীরার এই কথায় নীরার মা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কারণ উনারা তো কখনোই নুপুরের কথা মুখেও আনেনি।
..
আজ সাত দিন পার হয়ে গেলো। নুপুরের বাবা ও রাজ এখনো নুপুরের কোনো হুদিশ পায়নি।
সন্ধ্যায় নুপুরের বাবা ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় এসে সোফায় বসলো। নুপুরের মা ধীরে ধীরে নুপুরের বাবার পাশে বসলো। নুপুরের বাবা একটু নড়েচড়ে উঠলো।
- কিগো.. মেয়েটার কোনো খবর পেলে?
- নাহ! কতো জায়গায় খোজলাম, কেউই ওর কোনো সন্ধ্যান দিতে পারলো না।
- একবার কি পুলিশে জানিয়ে দেখবা?
- দেখি, কি করা যায়।
- সারাদিন কতো জায়গায় ঘুরলে। খিদা পেয়েছে নিশ্চয়ই। চলো খেয়ে নাও।
- খেতে ইচ্ছা করছে না নুপুরের মা। মেয়েটার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। আজ আমার কারণেই...
হুহু করে কেদে দিলো নুপুরের বাবা। নুপুরের মায়ের ও বুক ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু তবুও নিজেকে শক্ত রাখলেন তিনি। তার স্বামী এমনিতেই ভেঙ্গে পরেছে। এখন যদি সেও কাদে, নিজের স্বামীকে সামলাতে পারবে না নুপুরের মা।
..
রাজ ঘরের এক কোনায় বসে আছে। তার চোখে এখন পানির ধারা বয়ে চলেছে। রাজের হাতে একটি ফ্রেম । রাজ আর নুপুরের বিয়ের ছবি। ছবিটা নুপুর বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই স্টোররুমে ফেলে রেখেছিলো। আজ অনেক খোজে সেটা বের করলো রাজ। এই ছবিটা বুকে নিয়ে রাজ কাঁদছে। নুপুরকে খোঁজে পাচ্ছে না সে। কিন্তু নুপুরকে যে তার লাগবেই। অনেক কথা বলার আছে তার। তাকে যে নুপুরের কাছে মাফ চাইতেই হবে। কাঁদছে রাজ। হটাৎ ই কি যেনো মনে হলো তার। দৌড়ে গিয়ে রুমের ওয়াড্রবের কাপড় বের করতে লাগলো। কিছু খোজছে সে। কিন্তু পাচ্ছেনা। আলমারি, সুকেস, ওয়াড্রব, টেবিল .. বিছানার নিচ, কিছুই বাদ রাখছে না সে। কিন্তু পাচ্ছে না। অস্থির হয়ে যাচ্ছে রাজ। কোথায় আছে ফাইলটা? নুপুর যাওয়ার সময় তো নেয়নি। তাহলে গেলো কোথায়?
তারাতা‌ড়ি রুম থেকে বেরিয়ে নিচে গেলো রাজ। দারোয়ান চাচা গেইটের সামনে বসে ঝিমুচ্ছে। রাজ উনাকে জাগিয়ে তুললেন।
- চাচা, চাচা..
ধরফড়িয়ে উঠলো দারোয়ান।
- সাহেব, কি হইছে?
- আমাদের বাসায় কেউ আসছিলো?
- না! তো.. এই কয়দিনে কেউ তো আসেনি। কেন বাবা? কি হইছে?
- মনে করে দেখেন চাচা... কেউ আসছে কিনা।
না আসলে ফাইল টা গেলো কোথায়?
- কিসের কথা কইলেন বাবা।
- একটা ফাইল। যেটাতে নুপুরের আইডেন্টিটি সহ সব পেপার ছিলো। সে আপনি বুঝবেন নাহ।
- ওইগুলো তো নুপুর মা এসে নিয়ে গেছিলো।
আনমনে দাড়িয়ে ছিলো রাজ। দারোয়ানের কথা শুনে চমকে উঠলো রাজ। দারোয়ান কে বললো..
- কি বললে চাচা? নুপুর এসেছিলো? আমার নুপুর এসেছিলো? কবে এসেছিলো? আমাকে কেন বললেন না?
- বাপজান.. আপনে তো তখন অন্য মাইয়ারে নিয়া ব্যস্ত ছিলেন। তখন আপনারে কইলে আপনি খুশি হওয়ার বদলে আরো রাগ হইতেন।
রাজ অবাক চোখে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো..
- কবে এসেছিলো..
- আপনি ওরে বাসা থেইক্কা বাইর করনের পনেরো দিন পর আইছিলো। চাকরি করবো বইলা এইগুলান নিতে আইছিলো। আমারে দিয়াই আনাইছিলো এগুলো।
রাজ কাঁদছে। যে নুপুর ছোট থেকে বড় হয়েছে রাজকন্যার মতো। যে বাবার বাসায় কখনো নিজের হাত দিয়ে ভাত খায়নি , সেই নুপুর আজ চাকরি করে, প্রেগন্যান্সি অবস্থায় চাকরি করছে। এতো কষ্ট করছে আমার নুপুর? আর্তনাদ করে উঠলো রাজ।
কাঁদতে কাঁদতে দারোয়ান কে জিজ্ঞাসা করলো..
- চাচা, আপনি কি জানেন নুপুর কোথায় গেছে? মানে, আপনার কাছে কি কিছু বলেছে?
- হ বাবা, মাইয়াডা চিটাগাং থাকে, কইছিলো ওইখানেই চাকরি হইছে।
রাজ চিটাগাং নামটা শুনেই নিজের রুমে দৌড় দিলো। রুমে গিয়ে একটা শার্ট পরে আর ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা আর ফোনটা নিয়েই বেরুলো চিটাগাং এর উদ্দেশ্যে। গেইট থেকে বেরোবার সময় দারোয়ান জিজ্ঞাসা করলো..
- এতো রাইতে কই যাইতাছেন বাবা?
- চিটাগাং, নুপুরকে খোজতে। বলেই আর কোনো জবাবের অপেক্ষা না করে ছুটতে লাগলো রাজ।
দারোয়ান চাচা পিছন থেকে অনেক ডাকছে.. কিছু একটা বলবে বলে, কিন্তু উনার কথাকে পাত্তা না দিয়েই ছুটে গেলো রাজ।
..
রাতের বাসে চিটাগাং গেলো রাজ। বাস থেকে যখন নামলো তখন রাত ৪ টা বাজে। এতো রাতে নুপুরকে তো আর খোজা যাবে না। কিন্তু কি করবে এতো রাতে? আশেপাশে তাকালো রাজ। পাশেই ছোট্ট টং এর উপর একটা দোকান দেখতে পেলো সে। সামনে দুইটা বেঞ্চ পাতা। সেখানেই গিয়ে বসলো রাজ। চোখ গুলো বন্ধ হয়ে আসছে তার। দুইটা বেঞ্চ পাশাপাশি রেখে তার উপর শুয়ে পরলো রাজ। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে গেলো সে।
.
একটা পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে আছে নুপুর। চোখে তার পানি। সেই পানি শান্ত নদীর মতো বয়ে চলেছে। নুপুর সেখানে দাড়িয়ে থেকেই নিচের পেটের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। তারপর পেটের উপর নিজের হাত রাখলো।
নিজের পেটেই নিজে কতোক্ষন হাত বুলালো সে। সেই সাথে কান্না তো আছেই।
নুপুর পেটের দিকে তাকিয়ে বললো..
- দেখনা.. আমি কতো টা দুখী। এখন তুইও আমার মতোই দুখী হলি। আমার বাবা মা থেকেও নেই। স্বামী থেকেও নেই। আজ আমি একা। আল্লাহ কেন আমার ভাগ্যটা তোকে দিলো। আমার মতো তুইও যে এতিম। বাবা থেকেও যে আজ তোর বাবা নেই। যদি কেউ তোকে তোর বাবার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে তখন কি বলবি? মরে গেছে এটা বলবি? না! না, সেটা কি করে হয়। উনি অনেক বছর বেচেঁ থাকুন দোয়া করি। কিন্তু তাহলে কি বলবি? তোর বাবা টাকার জন্য তোর মাকে বের করে দিয়েছে, সেটা বলবি? তখন যে তোর আর তোর মায়ের অসম্মান হবে। তখন যে তোর বাবাকে সবাই খারাপ বলবে। সেটা তো আমি সহ্য করতে পারবো না। আর না তুই সহ্য করতে পারবি। তার চেয়ে সহজ উপায়.. আমরাই যদি না থাকি তাহলে আর জীবনেও এইসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। চল আমরা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই.. কি হবে রে এই পৃথিবীতে থেকে? এইখানকার মানুষ গুলো যে বড় নিষ্ঠুর। তুই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বড় হো সেটা আমি চাইনা। চল আমরা চলে যাই আল্লাহর কাছে।
কথাগুলো বলে নুপুর একপা দুপা করে পাহাড়ের কিনারায় এসে দাড়ালো। ।চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছেই তার। আস্তে আস্তে নিজের চোখগুলো বন্ধ করলো সে। তারপর পাহাড় থেকে একটা লাফ দিলো। লাফ দেওয়ার সাথে সাথে জোরে আর্তনাদ করে উঠলো নুপুর। তার রক্তাক্ত শরীর টা একটা খাদে গিয়ে পরলো।
..
To be Continue ......
প্রত্যাখ্যান- Part_10 প্রত্যাখ্যান- Part_10 Reviewed by NINDOOK LIFE on January 26, 2020 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.