বৃষ্টির_ফোঁটা_আমার_নয়

বোরখা পরে আঁটসাট করে নেকাব বেঁধে লুকিয়ে লুকিয়ে জামান সাহেবকে দেখা আমার বরাবরের অভ্যাস।একদিন আমিই তাকে বলেছিলাম,
---জীবদ্দশায় তোমার ওই মুখটা আর কখনও আমায় দেখাবে না।
তাই বলে কি আমি তাকে না দেখে থাকতে পারি?তাইতো আজ পঁয়ত্রিশটা বছর ধরে তাকে দূর থেকে দেখে আসছি।
.
বয়সের ভারে চুল দাড়িতে পাক ধরার সাথে সাথে আমার জামান সাহেবের ঝাপসা চোখ দুটোও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে।অথচ আমি একসময় খুব করে চাইতাম,প্রয়োজনে সে আমার চোখে সুন্দর এই পৃথিবী দেখবে তবুও তার ঝাপসা চোখ দুটোকে আমি কখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে দেবো না।কিন্তু এক জীবনে সব চাওয়া কি আর পূরণ হয়?হয়না।চাওয়া পাওয়ার ব্যর্থতাই তো জীবন।তাইতো নিজের সবটুকু দিয়ে ভালবাসার পরও জামান সাহেব আর আমার হলোনা।আমি দূর থেকে তাকিয়ে দেখছি তার চঞ্চলতা,আজও যেন সে সেই ২১ বছরের তরুণটিই রয়ে গেছে।আর তার ঠোঁটের কোণে ভূবন ভুলানো হাসি,আহা হা!যা আমার তপ্ত হৃদ শীতল হওয়ার কারন।তার এই হাসিটাকে যে আজও আমি প্রচন্ড ভালবাসি।
.
মনে পড়ে যায় উচ্ছ্বাসিত অনুভূতিতে তার আমার একসাথে কাটানো দিনগুলির কথা।পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হেঁটেছি কতটা পথ,একে অপরের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে কাটিয়েছি কতশত প্রহর।সেসব আজ শুধুই স্মৃতি,চোখের কার্নিশে জল গড়িয়ে পড়ার কারন।একবার হলো কি প্রেমের স্নিগ্ধতায় মগ্ন হয়ে ভবিষ্যত বাচ্চার নাম-ই ঠিক করে ফেললাম।ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক ডাক নাম হবে কৈতরী ব্যস্।এই নিয়ে ক্যাম্পাসের বন্ধু-বান্ধবেরা অট্টহাসিতে মেতে উঠে কতই না ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলল।কেউ বলল,,,
----কেবল প্রেম করতাছোস।ভবিষ্যতে বিয়ে হবে নাকি হবেনা তার নাই ঠিক।তার আগেই এত আবেগ তোদের কোথ থেকে আসে?
আরেকজন বলল,,,
----কি ব্যাপার আমাদের না জানিয়ে কাজটা আবার গোপনে সেরে ফেলিসনি তো?
আবার অন্য একজন বলল,,,
-----আরেহ রাখ তো তোরা,প্রেম করার সময় এমন টুকটাক রোমান্টিসিজমতা থাকবেই,ভবিষ্যতে দেখা যাবে কেলেঙ্কারি কান্ড।সমবয়সী রিলেশনে বাচ্চার নাম ঠিকই রাখা হয় কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে বাচ্চার বাপটা পাল্টে যায়।তখন মাফির বাচ্চার মামা ডাকে জামান না হয় দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটালো।
আমার জামান সাহেব সবসময়-ই একজন ধীর চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মানুষ।কোথায় কি বলতে হবে সেটা সে মাথা খাটিয়ে ভেবে চিন্তে তারপর বলে।সবার অট্টহাসির মাঝে জামান আমার হাত ধরে সকলের সামনে গম্ভীর স্বরে বলল,,,
----একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো সবাই,আমি জামান এই মেয়েটার সাথে শুধুমাত্র টাইম পাসের জন্য প্রেম করিনা।আমি তাকে প্রচন্ড ভালবাসি।হতে পারে তা নিজের থেকেও বেশি।আর হ্যা যুগলবন্ধী প্রেমিক প্রেমিকারা প্রেম করার সাথে সাথে ভবিষ্যত স্বপ্নেও অভিভূত হয়।আমিও স্বপ্ন দেখি আজ এই মেয়েটাকে ভালবাসতেছি,একদিন সে আমার ঘরের লাল টুকটুকে বউ হবে আর কোনো একদিন তার কোল জুরে আসবে আমার একটা ফুটফুটে বাচ্চা।
সেখানে পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টা তো ভাগ্যের লিখনী মাত্র।তাই বলে স্বপ্ন দেখতে মানা আছে কি?
সবাই নিশ্চুপ।কোনো কথা নেই কারো মুখে।
আমি জামানের মুখে এরুপ মায়াভরা কথা শুনে সেদিন দ্বিতীয়বারের মত তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।কতই না স্পর্শকাতর স্বপ্নগুলো তার।অথচ একদিন সে নিজেই আমার সকল স্বপ্নকে ভেঙে চুরে গুড়িয়ে দিলো।এতে অবশ্য এখন আর আমি তার দোষ দেই না।আমি তার কথাই বলি,হয়ত স্বপ্নগুলো আমার ভাগ্যে ছিলো না।
.
ক্যাম্পাসে সেদিন বন্ধু-বান্ধবের বলা প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।তবে সেটা উল্টোভাবে।হুম,বাচ্চার বাবা না পাল্টালেও বাচ্চার মা কিন্তু ঠিকই পাল্টে গেলো।একটা সম্পর্কে রাগ-অভিমান-ঝগড়া থাকবেই,বিচ্ছেদও হবে শত সহস্রবার।ভুল ত্রুটি হবে আবার ক্ষমাপ্রার্থীও হতে হবে।এটাই তো একটা সম্পর্কের নিয়ম।আমাদের সম্পর্কেও নিয়মগুলি তার ব্যতিক্রম ছিলো না।আমি তার সব দোষ ক্ষমা করেছি, অভিমান ভেঙে আবারও দুষ্টুমিষ্টি ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছি।তাই বলে বিয়ে করে এসে যখন সে আমায় বলল,,,
-----মাফি আমায় ক্ষমা করে দাও,আমার কোনো উপায় ছিলো না।
আমি পারিনি তাকে ক্ষমা করতে।এমনটা হওয়ার তো কোনো কথা ছিলো না।নিজের ভালবাসাকে অন্যের কাছে সপে দিয়ে নিশ্চুপে ক্ষমা করার মত মহৎ গুণ আমার ব্যক্তিত্বে নেই।আমি শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝড়িয়েছি।কিছু বলার মত বাকশক্তি আমার ছিলো না।দ্বিতীয়বার যখন সে আমার কাঁধে হাত রেখে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,,,
----কি হলো মাফি কথা বলছো না কেনো?প্লিজ তুমি এমন নিরব থাকলে আমার আরো বেশি কষ্ট হয়।
আমি নিরবে নিভৃত যতনে তার হাত দুখানা ঝারি দিয়ে সরিয়ে কড়া গলায় বলেই ফেললাম আমায় যেন কোনোদিন আর সে মুখ না দেখায়।সেই থেকেই তার আর আমার দ্বিতীয়বার কোনোদিন আর সাক্ষাত হয়নি।কিন্তু বছরের মাথায় একটা দিন তাকে লুকিয়ে দেখার আমার এই জঘন্য অভ্যাস আজও কেউ কাটিয়ে তুলতে পারেনি।তিন সন্তানের জনক হয়ে শুনেছি জামান সাহেব খুব সুখেই দিনাতিপাত করছে।অথচ আমার দ্বারা সংসার ধর্ম আর হয়ে ওঠেনি।সারাবছর হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াই এখানে ওখানে আর বছরের একটা দিনে মন ভরে দেখি তাকে।কিন্তু এই বছরে তাকে দুইবারই দর্শন করে ফেল্লাম।গতকাল রাতে তার গায়ের গন্ধওয়ালা সেই টি-শার্ট টা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।যেটা তার আমার সম্পর্কের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আজও অটুট আছে আমার কাছে।আলমারি আর সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন টি-শার্ট টা খুঁজে পেলাম না আমার বুকটা ধক করে উঠলো।অজান্তেই চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো।আমার মনে হচ্ছিলো আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমি এতটা আঘাত পেলাম যে আমার মনে হচ্ছিলো জামানকে হারানোর সময়টাতেও আমার এতটা কষ্ট হয়নি ।আমি সবসময়ই টি-শার্টটা বুকে জড়িয়ে নিজেকে স্বান্তনা দিতাম সে আমার হয়নি তো কি হয়েছে তার স্মৃতিচিহ্ন তো আমার কাছে রয়ে গেছে,বেঁচে থাকার জন্য আমার এটুকুই যথেষ্ট।কিন্তু গতকাল টি-শার্ট টা খুঁজে না পাওয়ায় মনে হচ্ছিলো আমি জামানকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি,আর হয়ত তার দেখা মিলবে না এ জীবনে।কিন্তু পরবর্তীতে টি-শার্টটা পার্সের মধ্যে খুঁজে পেয়ে ওটাকে বুকে নিয়ে কি কান্নাটাই না কাঁদলাম।খুব বেশি ভালবাসার জিনিস তো তাই কখনও চোখের আড়াল করতে চাইনা।অথচ বয়স তো আর কম হলোনা,তাই প্রায়শ-ই ভুলে যাই কোথায় কি রাখলাম।
.
রাত পোহালে ডিসিশন নিয়েই ফেললাম টি-শার্ট হারানোর ছুঁতোয় একটাবার না হয় মানুষটাকে দেখেই আসি।তাইতো আজ এখানে আমার আগমন।মানুষটাকে দেখে আজ আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।বুকের ভিতর তুমুল আকারে ভেঙে চুরে যাচ্ছে।মানুষটাকে আমি এভাবে কোনোদিন দেখবো তা কল্পনাও করতে পারিনি। কারন,হাসিখুশি মানুষটার জীবনে সংসার, সন্তান, স্ত্রীর অভিসারে খামতি শুধু এটুকুই,জীবনটা তার আলোকিত হওয়া সত্তেও তার ঝাপসা চোখে আজ আর আলো নেই।অথচ চশমার ফ্রেমে বন্দি তার ঝাপসা চোখ দুটোকেই যে আমি প্রচন্ড ভালবেসেছিলাম।
.
মুরব্বিদের সাথে আড্ডা দিয়ে জামান সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছে।লাঠির ভরের অনুভূতি দৃষ্টিগোচর করে জামান সাহেব হাটি হাটি পা পা করে সামনের দিকে আগাচ্ছে।আমি না চাইতেও কেন জানি তার দিকে ছুটলাম।বহুবছর পর আজ তার মুখোমুখি হবো ভেবেছি।ইটের খোয়ায় ধাক্কা লেগে সে ব্যালেন্স হারালো,আমি তাকে ধরলাম।ঠিক যেমনটা ক্যাম্পাসের মাঠে একসাথে হাঁটতে গেলে আমি হোচট খেতাম, আর সে তার ভরসার হাত দিয়ে আমায় আগলে রাখতো।আজ হয়তো বিধাতার এটাই নির্দেশ ছিলো,তাইতো মুহূর্তের জন্য হলেও তার ভরসা হতে পেরেছি।আমি তার হাতে লাঠিটা ঠিক করে ধরিয়ে দিয়ে খোয়াটা সরিয়ে দিলাম।তার সামনে নিজেকে ধরে রাখতে সমস্ত শরীর কাঁপছিলো।তাই পালিয়ে বাঁচতে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম।এক পা এগোতে না এগোতে থমকে দাঁড়ালাম সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর শুনে,,,
----দাঁড়াও মাফি।এত বছর পর আজও আমার কাছ থেকে এভাবে পালিযে বেড়াচ্ছো?এত অভিমান তোমার?
আমি ধীরগতিতে তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,,,
-----অন্ধকার চোখে তো আমায় দেখতে পাওনি জানি,তবুও আমায় চিনলে কি করে?
সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,,,
-----চোখ অন্ধকার হয়েছে,মনটা আজও কলুষিত হয়নি।সেই চেনা স্পর্শ,সেই চেনা গন্ধ, সেই হৃদয় নাড়ানো অনুভুতি,আর নিঃশ্বাসের তীব্রতা আমার মনটা তা ঠাওর করতে ভুল করেনি।কারন ভালো তো আমি তোমাকে মন থেকেই বেসেছিলাম।
এই বয়সে তার প্রতি কোনো ক্ষোভ আর অভিমান আমার থাকা উচিত না সেটা আমি জানি।তবুও কেন জানিনা আমি আবারও অভিমানের স্বরেই বললাম,,,
----হ্যা মন থেকে ভালোবেসেছিলে বলেই তো আজ আমিহীন তুমি সংসার ধর্ম নিয়ে ভালো আছো।
আমার কথা শুনে জামান সাহেব আবারও সেদিনের মত আমার হাত দুটো ধরে কাঁপা কন্ঠে বলল,,,
----দয়া করে এই শেষ বেলাতে তুমি আমায় ক্ষমা করো মাফি।বিশ্বাস করো আমি সত্যিই বাধ্য ছিলাম।
আমিও ঠিক সেদিনের মতই হাত ছাড়িয়ে নিলাম।তবে আজ আর নতুন করে কিছু বলতে পারিনি।
.
আকাশে এক টুকরো মেঘ জমেছে,অথচ বৃষ্টিরা ঝড়ছে আমার চোখে।আমি পা বাড়ালাম আমার গন্তব্যের দিকে,পিছু ফিরে আর তাকাইনি।হয়ত জামান সাহেব সেদিনের মত আজও আমার পানে অসহায়ত্বের চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।পার্থক্য শুধু একটাই,সেদিন তার চোখে আলো ছিলো আর আজ যেখানে শুধুই অন্ধকারের বসবাস।
.
খানিকবাদে মেঘ কেটে আসমান থেকে জমিনে বৃষ্টিরা ছুটছে তুমুল বেগে।চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি মিলে মিশে একাকার।তবুও যেন শত ফোঁটা বৃষ্টির পানির মাঝে এক ফোঁটা চোখের পানিই আমার একান্ত আপন।আমি মাঝপথ বরাবর আনমনে হেঁটেই চলেছি।প্রকৃতির কোনো কিছুই যেন আমার অন্তর্দেশে সাড়া জাগায়না।আমি ডুবে আছি মগ্ন ভাবনাতে,,
"ভালবাসা তুমি অন্তরে ছিলে,
"কিন্তু ভাগ্যে ছিলে না"।


বৃষ্টির_ফোঁটা_আমার_নয় বৃষ্টির_ফোঁটা_আমার_নয় Reviewed by NINDOOK LIFE on January 26, 2020 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.